Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, April 2, 2011

আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই


আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই
 
 ১ এপ্রিল ২০১১
মঙ্গল কুমার চাকমা
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদিবাসী পরিচিতিকরণের আরও একটি মৌলিক বিষয় বা অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের অধিকার। নিজেদের পরিচয় নিজেরাই নির্ধারণ করবে এটাই ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
মূল দৃষ্টিভঙ্গি


বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী আইনকে সংবিধানবহির্ভূত ও বেআইনি মর্মে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে বর্তমান মহাজোট সরকার কর্তৃর্ক সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশের আদিবাসী জাতিগুলো আশা করে যে, সরকার কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর সেই প্রত্যাশার আলোকে 'আদিবাসী জাতি' হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাঁচ সংসদ সদস্যসহ আদিবাসীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কাছে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিনামা পেশ করা হয়েছে।
অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে, গত ১৫ মার্চ ২০১১ অনুষ্ঠিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির দশম সভার পর জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'আদিবাসী হিসেবে নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদীয় কমিটি।' তিনি আরও বলেছেন, 'আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবির ক্ষেত্রে কমিটির সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আমরা হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের জাতি। এখানে আমাদের কোনো ঔপনিবেশিক শাসন ছিল না। এমনকি মধ্যযুগেও না। তাই অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় যে অর্থে আদিবাসী বোঝায় আমাদের এখানের উপজাতিরা তেমন নয়। তাই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের মাধ্যমেই তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।'
বস্তুত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওই বক্তব্য যথাযথ নয় বলে আমরা মনে করি। এখানে 'আদিবাসী জাতি' বলতে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া যে অর্থে বোঝানো হয় সেই অর্থে কেবল 'প্রথম বা আদি অধিবাসীদের' বোঝায় না। সেই বৈশিষ্ট্য ছাড়াও যাদের সমাজব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশের মূলস্রোতধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি হতে পৃথক, যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করে, ভূমির সঙ্গে যাদের নিবিড় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং যারা সাধারণভাবে মূলস্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে সেই অর্থে আদিবাসী হিসেবে বোঝানো হয়ে থাকে।
শেষোক্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশের মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশে যেমন_ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশেও এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের 'আদিবাসী জাতি' হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। জাপানের হাক্কাইদো দ্বীপের আইনুদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে জাপান সরকার। ফিলিপাইনের ১১০টি জাতিগোষ্ঠীকে সরকার আদিবাসী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে জাপানের বা ফিলিপাইনের মূল জনগোষ্ঠী কিন্তু বহিরাগত বা অ-আদিবাসী হয়ে যায়নি। বরঞ্চ এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে আদিবাসী জনগণের প্রতি যে বৈষম্য ও বঞ্চনা বিদ্যমান রয়েছে তা দূরীভূতকরণের একটি কার্যকর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং আদিবাসীদের তাদের পরিচয় ও স্বকীয়তা বজায় রেখে দেশের নাগরিক হিসেবে মূল স্রোতধারার কর্মকাণ্ডে যথাযথভাবে অংশগ্রহণের সমসুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সেনগুপ্ত যেটা বলেছেন আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো আদি বাসিন্দাদের পদানত করে দখল করার কোনো বিষয় ঘটেনি তাও সর্বাংশে সঠিক নয়। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি সুস্পষ্ট ও ঐতিহাসিকভাবে সমর্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ এ অঞ্চলের প্রথম জনজাতি বা ভূমিপুত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বেশি দূরের কথা নয়, দেশ বিভাগের সময়কালে চলিল্গশ দশকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯৭% লোক ছিল আদিবাসী জুম্ম বংশোদ্ভূত। বাকি ৩% ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠী যারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সেখানে সাময়িক অবস্থান নিয়েছিল বা তারও আগে আদিবাসী সামন্ত রাজারা লাঙল চাষ প্রবর্তনের জন্য কিছু বাঙালি পরিবারকে বসতি প্রদান করেছিল।
আর ময়মনসিংহের আদিবাসী অধ্যুষিত শেরপুর, শ্রীবর্দী, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা এই ছয়টি অঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাকে 'আংশিক শাসনবহির্ভূত এলাকা' হিসেবে চালু ছিল যা আদিবাসী অঞ্চলেরই সাক্ষ্য বহন করে। উত্তরবঙ্গের শ্বাপদসংকুল বরেন্দ্র অঞ্চলকে বা মধুপুর গড় অঞ্চলকে কর্ষণযোগ্য ও বাসযোগ্য করেছে খেতে খাওয়া এই আদিবাসীরা। কিন্তু তাদের জায়গা-জমি, পাহাড়-বন, আবাসস্থল শক্তির জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারা বর্তমানে নিজ বাসভূমে পরবাসী একশ্রেণীর অসহায় মানুষে পরিণত হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে ঐতিহাসিক কারণে তাদের ওপর এই বঞ্চনা ও বৈষম্য শুরু হয়েছে।
উলেল্গখ্য, দেশের অনেক আইনে, সরকারি পরিপত্র ও দলিলে এবং আদালতের রায়ে এসব জাতিকে 'আদিবাসী' বা তার সমার্থক গোষ্ঠী হিসেবে উলেল্গখ করা হয়েছে। যেমন_ পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ আইনে ধনড়ৎরমরহধষ পধংঃবং ধহফ ঃৎরনবং শব্দ ব্যবহার হয়। ১৯৯৫ সালের অর্থ আইন রহফরমবহড়ঁং যরষষসবহ ও 'আদিবাসী গিরিবাসী' শব্দ ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের আয়কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিশেষ প্রবিধান রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ (১৯০০ সালের ১নং রেগুলেশন) আইনে রহফরমবহড়ঁং ঃৎরনবং এবং রহফরমবহড়ঁং যরষষসধহ শব্দ ব্যবহৃত হয়।
শুধু তাই নয়, আপনি স্বয়ং ২০০০ ও ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত 'সংহতি' সংকলনে প্রদত্ত বাণীতে এসব জাতিকে 'আদিবাসী' হিসেবে উলেল্গখ করেছিলেন। এছাড়া আপনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে সুস্পষ্টভাবে 'আদিবাসী' শব্দটি উলেল্গখ রয়েছে। উলেল্গখ্য, ২০০৯ সালের আদিবাসী দিবসে আপনি আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, 'আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চিরায়ত জ্ঞান, নৃত্য-গীত, সাহিত্য, জীবনের মূল্যবোধ পৃথিবীর জন্য অমূল্য সম্পদ। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহ্যগত জ্ঞান। সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধপরিকর এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নেও আমরা একযোগে কাজ করতে চাই।' বর্তমান সরকারের এতগুলো স্পষ্ট ও দৃঢ় অঙ্গীকারের পরও আদিবাসী হিসেবে নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের যে অবস্থান নিতে যাচ্ছে তাতে দৃশ্যত মনে হয়, কোথাও কোনো বিভ্রান্তি হয়েছে। আদিবাসী শব্দের অর্থ নিয়ে অন্যরকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অথবা কোনো বিশেষ প্রভাবশালী কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবে বা সরকার এই অগণতান্ত্রিক অবস্থান গ্রহণ করছে বলে দৃশ্যত প্রতীয়মান হয়। আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী অ-আদিবাসী বা বহিরাগত হয়ে যাবে বা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হবে এমন তো কোনো বিষয় নয়। বরঞ্চ এসব জাতিকে 'আদিবাসী' হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র অধিকতর উন্মোচিত হবে। এতে করে এ দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা ও নৃতাত্তি্বক বহুমাত্রিকতা অধিকতর সমৃদ্ধশালী হবে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদিবাসী পরিচিতিকরণের আরও একটি মৌলিক বিষয় বা অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের অধিকার। নিজেদের পরিচয় নিজেরাই নির্ধারণ করবে এটাই ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূল দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে কোনো জনগোষ্ঠীর পরিচয় কোনো পক্ষ বা কোনো জনগোষ্ঠী বা কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয় নয়।
সঙ্গত কারণেই আদিবাসীরা 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' হিসেবে নয়, 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি চাই। আদিবাসীরা আশা করে, সরকার দেশের ৪৬টির অধিক আদিবাসী জাতিগুলোর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের হৃদস্পন্দন অনুভব করবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তৎসময়ে ১৯৯৭ সালে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং তার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটেছে; ঠিক একই দৃঢ়তায় ও সাহসিকতায় 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' হিসেবে নয়, 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসী জাতিগুলোর প্রাণের দাবি পরিপূরণে এবারও এ সরকার এগিয়ে আসবে এবং ইতিমধ্যে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনগুলো, আদিবাসী বিষয়ক পার্লামেন্টারি ককাস ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাঁচ আদিবাসী সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কাছে পেশকৃত সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিনামা মোতাবেক আদিবাসীদের জাতিগত পরিচিতি ও স্বকীয়তা, স্বশাসন বা বিশেষ শাসন, সিদ্ধান্ত নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এবং সর্বোপরি সমঅধিকার ও সমমর্যাদার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ সংক্রান্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সনি্নবেশকরণের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করবে_ এটাই আপামর আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।

মঙ্গল কুমার চাকমা : পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও
প্রচার সম্পাদক 
 
................................................................
source: Samakal

No comments:

Post a Comment