Why we want our voice to be heard?

Pages

Sunday, November 28, 2010

আদিবাসী জীবনে জীবন মেলাবার আয়োজন কবে হবে সঞ্জীব দ্রং | তারিখ: ০৪-১১-২০১০

আদিবাসী
জীবনে জীবন মেলাবার আয়োজন কবে হবে


সঞ্জীব দ্রং | তারিখ: ০৪-১১-২০১০


প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী তাঁর চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর উপন্যাসে ব্রিটিশ আমলের এক মুন্ডা হেডম্যান পহানকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?’ এখানে ‘গোরমেন’ মানে গভর্নমেন্ট। মুন্ডা আদিবাসীরা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিল, ইংরেজ মানেই ব্রিটিশ ও শাসক এবং তারা খারাপ। সে সময় বিহার রাজ্যের ছোট লাটসাহেব রনাল্ডসনের ভাই মুন্ডাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ইংরেজ লোকটি মুন্ডা আদিবাসী গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে আদিবাসী নারী-পুরুষের সঙ্গে ফটো তুলছিলেন এবং আদিবাসীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছিলেন, গ্রাম্য মেয়েদের সঙ্গে হাসি-তামাশায় মেতে উঠেছিলেন। এই দেখে অবাক হয়ে ওই মুন্ডা হেডম্যান পহান তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?’
আজ এতকাল পর ভাবি, ব্রিটিশ চলে গেল, পাকিস্তানিরা এখন নেই, এখন স্বাধীন বাংলাদেশ, যার জন্য অনেক আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে, তবু আদিবাসীজীবনে এত কষ্ট কেন? আজ গারো পাহাড়ের কোলে গারোরা সংখ্যালঘুতে পরিণত। হাজং, ডালু, বানাই ও কোচরা দলে দলে দেশান্তরি হয়ে গেল, সাঁওতাল-ওঁরাও-মুন্ডারা ভূমিহীন ও নিঃস্বসম্প্রদায়, নিজভূমিতে অনেকে দিনমজুর, খাসিয়াদের ভূমি নিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, মধুপুর বনে মান্দিদের অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে ইকো পার্ক বাতিলের পরও। শত শত বনসংক্রান্ত মামলার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। চলেশ, পিরেন, গিদিতা রেমা বা আলফ্রেড সরেন হত্যার কোনো বিচার হয়নি। কতবার আদিবাসীদের গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে; কোনো বিচার হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষ আবার হতাশাগ্রস্ত। পার্বত্য চুক্তির মূল চেতনাই হারিয়ে যেতে বসেছে। ধীরে ধীরে নয়, দ্রুত পাহাড়ের মানুষ নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। ভূমি ও বন বেদখলে চলে যাচ্ছে। নতুন নতুন পর্যটনশিল্প গ্রাস করছে পাহাড়ের ঐতিহ্যগত ভূমি। সব মিলিয়ে আবারও ওই কথাই প্রতিফলিত হচ্ছে, যা মহাশ্বেতা দেবী তাঁর বিখ্যাত বিরসা মুন্ডা উপন্যাসে লিখেছিলেন।

২.
একাত্তরে আমি নিজে শরণার্থী বালক ছিলাম। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেঘালয়ের একটি গ্রামে সেই উদ্বাস্তুজীবন। প্রথমে দিমাপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে কয়েক দিন ছিলাম। পরে ক্যাম্পের অবস্থা খারাপ দেখে আমরা চলে যাই খন্ডকপাড়া নামক একটি গ্রামে। সেখানে বাবা একটি ঘর কেনেন। যারা জীবনে শরণার্থী হয়নি, তাদের পক্ষে সে জীবন সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়। আমাদের সংরা গ্রামের এক আত্মীয় শরণার্থীজীবনে পরিবারের ১৩ সদস্য নিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন চার সদস্য নিয়ে। নয়জন উদ্বাস্তুজীবনে নানা রোগে, অসুখে মারা যান। আমাদের অনেক আত্মীয় তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আমার মামাদের মধ্যেই, যাঁরা ‘দ্রং’ সম্প্রদায়ের, ২০ জনের অধিক হবে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, জীবনও দিয়েছেন। তবু মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছি আমরা স্বাধীন দেশে। আবার দেশের অবস্থা, পরিস্থিতি এবং আদিবাসীদের অপমান দেখে অনেকে মেঘালয়ে ফিরে গেছেন। এমনকি যে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য জীবনপণ লড়াই করেছেন, স্বাধীনতার পর তাঁদেরও অনেকে দেশান্তরি হয়েছেন। এটি শুধু গারোদের ক্ষেত্রে নয়, অন্য আদিবাসীদের বেলায়ও ঘটেছে। আনিসুল হক তাঁর চিয়ারী বা বুদু উরাও কেন দেশত্যাগ করেছিল উপন্যাসে একজন ওঁরাও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি তুলে ধরেছেন। তাই বলা যায়, দিনের শেষে যে হিসাবটা দাঁড়ায়, তা হলো আদিবাসীরা স্বাধীনতার সুফল তেমন লাভ করতে পারেনি; অন্তত সামগ্রিকভাবে। আদিবাসীদের মধ্যে কিছু মানুষ হয়তো ভালো অবস্থানে গেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে আদিবাসীরা আরও অসহায় জাতিতে পরিণত হয়েছে। তারা জায়গা-জমি-বন ও পাহাড়ের অধিকার হারিয়েছে। দলে দলে গ্রামছাড়া ও দেশছাড়া হয়েছে। রাষ্ট্রে, প্রশাসনের মধ্যে, বৃহত্তর সমাজে আদিবাসী মানুষ, তাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সমর্থন কি বেড়েছে? আমার তা মনে হয় না।

৩.
আমরা বহুদিন ধরে আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলছি। প্রথমে বলতে চাই, আদিবাসীরা এ পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। এই যে পাহাড়, বন, প্রকৃতি, সমুদ্র, নদী, ভূমি—সবকিছুকে আদিবাসী পূর্বপুরুষেরা আজকের মানুষের জন্য যত্ন করে গড়ে তুলেছেন। এখন জাতিসংঘ নিজে স্বীকার করছে, পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের রয়েছে বিশাল অবদান। আধুনিক সভ্যতা বা উন্নয়নের ধারা আদিবাসীদের রেখে যাওয়া সব সম্পদকে দ্রুত ভোগের জন্য শেষ করে দিচ্ছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো পৃথিবীতে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, যা এখন আমরা হচ্ছি। পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্যই মানবসমাজের এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিতে হবে, অন্তত তত দিন পর্যন্ত, যত দিন না পৃথিবীতে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর হয়। ‘বাংলাদেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’ কথাগুলো শুনতে সুন্দর। কিন্তু বছরের পর বছর কথাগুলো সংবিধানের শুধু শোভা হয়েই থাকে, সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া মানুষ, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীসম্প্রদায় বা সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানুষের জীবনে এ কথাগুলোর বাস্তব প্রতিফলন নেই। এ জন্যই মানুষ ভিন্নভাবে, পৃথকভাবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সংখ্যালঘু বা আদিবাসীদের কথা বাদ দিলেও বলতে পারি, দেশের সাধারণ গরিব ও মেহনতি মানুষের জীবনেও সংবিধানের ওই সুন্দর কথাগুলোর প্রতিফলন নেই। সংবিধানের ২৭ ও ২৮ ধারায় আছে—
ধারা ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
ধারা ২৮(১)। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।
ধারা ২৮(৪)। নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
কিন্তু বাস্তবে সংবিধানের এ কথাগুলোর প্রতিফলন আদিবাসীজীবনে দেখতে পাই না। তাই আমরা অনেক দিন ধরে স্পষ্টভাবে আদিবাসীদের পরিচয় ও অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা বলে আসছি। কী দুঃখের কথা, স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছরেও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। এবার অবশ্য আমরা আশা করছি, সরকার আদিবাসীদের এই দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করবে।

৪.
বিশ্বব্যাপী আদিবাসীজীবনে শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ত। দেশে দেশে ঐতিহাসিক এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসীরা চিরকাল লড়াই করেছে। যাদের মাতৃভাষায় ‘শোষণ’ শব্দের প্রতিশব্দই নেই; কী আশ্চর্য, তাদের জীবনচক্র শোষণের শৃঙ্খলে বাঁধা। যেখানে, যে বনে ও ভূমিতে আদিবাসী মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে বংশপরম্পরায় বসবাস করে এসেছে, আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পর এক নিমেষে আদিবাসীরা হয়ে গেল নিজবাসভূমে অবৈধ ও পরবাসী। সরকার আদিবাসীদের কোনো মতামত না নিয়েই কাগজে-কলমে, আইন বানিয়ে, নোটিশ দিয়ে বলে দিল, এসব বন ও ভূমি সরকারের। যারা এতকাল নিজের জীবনধারণপ্রণালি দিয়ে এসব বন ও প্রকৃতিকে রক্ষা করেছিল আজকের মানুষের জন্য, আগামী দিনের শিশুদের জন্য, সেসব বন উজাড় হতে শুরু করল। কেননা আদিবাসীরা বনকে দেখত জীবনের অংশ হিসেবে, লাভ বা মুনাফার দৃষ্টিতে নয়। আজ আদিবাসী মানুষেরা অসহায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছে ২০০৭ সালে, যেখানে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ঘোষণাপত্রের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের বলে তারা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় করে এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করে।’ এ ছাড়া আদিবাসীদের ভূমির অধিকার, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি এবং আদিবাসীদের জ্ঞানের ওপর অধিকারের বিষয় ঘোষণাপত্রে যুক্ত আছে। বাংলাদেশে আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের ভাবনাচিন্তাও সরকারি পর্যায়ে নেই।
জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের ৭০টি দেশের আদিবাসী মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, পরিচয়, ভাষা, অস্তিত্ব বিপন্ন। ২০০০ সালে জাতিসংঘ আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন করেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধীনে। এ ফোরামের ১৬ জন সদস্যের মধ্যে আদিবাসী প্রতিনিধি আছেন কমপক্ষে আটজন। তাঁরা আদিবাসীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার—এ ছয়টি বিষয়ের ওপর কাজ করছেন। একটি তথ্য দিই, পৃথিবীতে যে ৩৭ কোটি আদিবাসী মানুষ আছে, তারাই পৃথিবীর পাঁচ হাজার মাতৃভাষার অধিকারী। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় ছয় হাজার ভাষার মধ্যে পাঁচ হাজারই আদিবাসীদের ভাষা। এসব ভাষার জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ।

৫.
আদিবাসীদের বঞ্চনা ও কষ্টের জন্য সব বাঙালি তো দায়ী নয়। কতিপয় শাসকগোষ্ঠী দায়ী। নগণ্যসংখ্যক। বাঙালিদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু আছে। গারো পাহাড়ের কোলে ছেলেবেলায় দরিদ্র বাঙালি মুসলমানের বাড়িতে দাওয়াত (ওরা বলত জেফত) খেতে গেছি। মনে পড়ে, ওরা ঘরের চৌকিতে বিছানায় কাঁথা বিছিয়ে ভাত খেতে দিত আমাদের। ওদের ঘরে চেয়ার-টেবিল বা বসার ঘর বা আলাদা খাবার ঘর ছিল না। যেখানে গরিব বাঙালি কৃষক স্বামী-স্ত্রী ঘুমান, সে বিছানায়ই কাঁথা বিছিয়ে আমরা ছেলেবেলায় গ্রামে ঈদের দিন দুপুরবেলা ‘জেফত’ খেতাম। কত আনন্দ মনে তখন। ওই বাড়িগুলো আমি এখনো দেখি। আমাদের বাড়ির কাছে, ওরা কত গরিব। বুকে খুব কষ্ট অনুভব করি। কিন্তু আমরা কোনো দিন কেউ কাউকে শোষণ করেছি বলে তো জানি না। কয়েক দিন আগে বাড়ি গেলাম। হালুয়াঘাটে সংরা বাজারের পাশে গাড়ি রেখে বাড়ির দিকে আমি হাঁটব। ছেলেবেলায় যাঁদের দেখেছি, তাঁদের কয়েকজন বাঙালি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন চেহারায়, আমাকে বললেন, ‘বাপু, তোমাকে কত দিন দেখি না। তোমার বাবা ছিল বলে আমরা বেঁচে ছিলাম। কত সহযোগিতা করেছেন।’ একবার ইকো পার্কের আন্দোলনের সময় মধুপুরে বৃদ্ধ বাঙালি মৌলভি সাহেব আকুলভাবে জনসভায় জলছত্র স্কুলের মাঠে বলেছিলেন, ‘এই বন বিভাগ আমাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে।’ গারোদের জনসভায় এসেছিলেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় আদি বাঙালিদের আমি দেখেছি, কথা বলেছি, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের এই করুণ দশার জন্য মন খারাপ করেন।...এই-ই তো ছিল আমাদের চিরকালের বাংলাদেশ। শাসকের দল একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছিল সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে, যা শান্তিচুক্তি নামে পরিচিতি পেয়েছে। চুক্তির এক যুগ পার হয়ে গেল, পাহাড়ি মানুষের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি তো দূরে থাকুক, আশাহত হচ্ছে মানুষ। চুক্তির মূল বিষয়গুলোই বাস্তবায়িত হয়নি; পাহাড়ে আদিবাসী মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বল্প পরিসরেও বাস্তবায়িত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ এক প্রকার ক্ষমতাহীন, জেলা পরিষদগুলো দলীয়ভাবে চলে। ভূমিসমস্যার সমাধান কবে হবে কেউ বলতে পারে না। এই মেয়াদে চুক্তির পক্ষের সরকারের প্রায় দুই বছর হয়ে গেল, সরকার ও চুক্তি স্বাক্ষরকারী পাহাড়ি নেতাদের মধ্যে ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সংলাপ’ শুরুই হয়নি। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে কয়েকটি কমিটি হয়েছে এবং কমিটির কয়েকটি বৈঠক হয়েছে; কিন্তু যে পরিমাণ অগ্রগতি হওয়ার কথা, তা হয়নি। পাহাড়ি মানুষের অভিযোগ, যে ধরনের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, সে রকম অগ্রাধিকার পায়নি গত দুই বছরে।

৬.
আদিবাসীজীবনে বিগত ৪০ বছরে কিছুই হয়নি—এ কথা বলা যাবে না। একটি স্বাধীন, মুক্ত দেশের নাগরিক হয়েছে তারা। কিন্তু নাগরিক অধিকার? নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার, মর্যাদা ও সম্মান? পরিচয়, সংস্কৃতি, ভূমির অধিকার? সব মিলিয়ে আশানুরূপ নয়। কবি শামসুর রাহমানের ‘কথা ছিল’ কবিতার লাইনগুলো যেমন—‘কথা ছিল, আমার আনন্দ-গানে ভরিয়ে তুলবো অলিগলি, জনপথ, অবাধ প্রান্তর/ আমার ভরাট গলা ছোঁবে দিগন্তকে/ কথা ছিল, পায়রা উড়িয়ে দেবো ভোরবেলা মেঘের কিনারে/ কথা ছিল উৎসবের কবিতা নিরুদ্বেগ লিখে মুছে ফেলবো সকল দুঃখ শোক/...কথা ছিল প্রত্যেককে দেখাবো অনিন্দ্য সূর্যোদয় মুক্ত মনে/...অথচ এখন, এ মুহূর্তে সূর্যাস্তের ছোপলাগা কবরের দিকে অসহায় চেয়ে থাকি/...বন্দীদশা এল বুঝি পুনরায়।’ এই কবিকে নিয়ে আমি রাঙামাটি, নেত্রকোনা, গারো পাহাড়ে আমার গ্রামে ঘুরেছি। কবির একটি মানবিক হূদয় ছিল আদিবাসীদের জন্য।
এত বঞ্চনার পরও যে কথা বলা দরকার, তা হলো ইদানীং আদিবাসীদের নিয়ে সভা, সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি হচ্ছে। মিডিয়ার ভূমিকাও আদিবাসী ইস্যুতে বেড়েছে বলা যায়। নাগরিক সমাজের মধ্যে অল্পবিস্তর হলেও একধরনের সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে আদিবাসীদের বিষয়ে। দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী তাঁদের শাসনকালে আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছেন। ইউএনডিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ফ্লোর হয়েছে, সেখানে দেয়ালে দেয়ালে পাহাড়ি জীবনের ফটো বাঁধানো আছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার ১০০ পাহাড়িকে বিশেষ বৃত্তি দিয়ে নিয়ে গেছে। এনজিওগুলো পাহাড়ে কাজ করছে, আদিবাসী অধিকার আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসছে আদিবাসী বিষয়ে, টিভিতে লাইভ টক শো হচ্ছে, আদিবাসী সংসদীয় ককাশ হয়েছে, পত্রিকাগুলো গোলটেবিল বৈঠক করছে। শিক্ষানীতি ও শিশুনীতিতে আদিবাসীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নতুন একটি আইন হয়েছে আদিবাসীদের মতামত না নিয়েই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’ আদিবাসীদের অস্বীকৃতি জানিয়ে। সবকিছু ছাপিয়ে যা হয়নি গত ৪০ বছরে, তা হলো আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, যেখানে তাদের আত্মপরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বাঙালি ও আদিবাসীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা ও আস্থাহীনতাও বড় চ্যালেঞ্জ।
পাহাড়ি মানুষের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় সংসদে একটি শোষণহীন সুন্দর সমাজ গড়ার কথা বলেছিলেন, যেখানে কোনো জাতিগত নিপীড়ন থাকবে না। এমন একটি সমাজের কথা তিনি বলেছিলেন, যেখানে পাহাড়ি মানুষেরাও মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে। ৪০ বছর পার হয়ে গেল।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ‘পাহাড়ি জনপদে জীবনের অন্বেষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
কথা ছিল বাংলাদেশের ভাগে যে আকাশটুকু পড়েছে, তার অধিকার সব মানুষের সমান থাকবে। থাকেনি।
কথা ছিল দেশের প্রধান জাতিসত্তার মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। থাকেনি।
কথা ছিল পাহাড়ি বনভূমি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের আবাস হয়ে ভূমির অধিকার নিশ্চিত থাকবে। থাকেনি।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও এই যে এত বঞ্চনার ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে আদিবাসীদের, এর দায় ও লজ্জা কি নেব না আমরা? কবে শুরু হবে আদিবাসীজীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার আয়োজন?
 সঞ্জীব দ্রং: সাধারণ সম্পাদক, আদিবাসী ফোরাম



---------------

courtesy: prothom-alo

No comments:

Post a Comment