Why we want our voice to be heard?

Pages

Thursday, September 16, 2010

 পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পার্বত্যবাসীর সংশয়

পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পার্বত্যবাসীর সংশয়

অরুণ কর্মকার ও হরি কিশোর চাকমা |



পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে ওই অঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে প্রায় সবাই সন্দিহান। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই মনে করেন, এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না। কোনো সরকারই ওই চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না বা করতে পারবে না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে এই চুক্তি করেছিল। বর্তমান মহাজোট সরকারও আওয়ামী লীগেরই নেতৃত্বাধীন। বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের। ক্ষমতা গ্রহণের পরও একাধিকবার বলা হয়েছে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা।
শুধু কথা নয়, এ লক্ষ্যে সরকার জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছে। চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়েছে। ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি কমিশন যাতে আগের মতো অকার্যকর না হয়, সে জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার পরও চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে সন্দেহ কেন?
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস): দলের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেছেন, চুক্তির বাস্তবায়ন পরিস্থিতি কার্যত অচলাবস্থায় আছে। আগের সরকারের মতো বর্তমান সরকারও সময় পার করার পদ্ধতি অনুসরণ করছে। চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারের কোনো আন্তরিকতা বা সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না।
সন্তু লারমা বলেন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধন না করে তো চুক্তি বাস্তবায়নের পথে সরকার এক পা-ও এগোতে পারবে না। ২০০১ সালে প্রণীত ওই আইন সংশোধনের বিষয়ে ২০০২ সাল থেকেই কথা হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে জেএসএসের ১৯টি সংশোধনী প্রস্তাবের সবগুলোর ব্যাপারেই একমত হয়েছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। এরপর বিষয়টি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন কমিটির কাছে গিয়ে অজ্ঞাত কারণে আটকে গেল। এরপর জেএসএস আরও চারটি সংেশোধনী প্রস্তাব দিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই সংশোধনীগুলো অপরিহার্য। কিন্তু সরকার নাকি এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কয়েকটি মাত্র বিষয়ে আইন সংশোধনের। তাতে তো সমাধান হবে না। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এখনো তা-ই আছে। চুক্তির ফসল পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে না।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমাও চুক্তি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সম্পর্কে একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেমে আছে। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের পরিকল্পনা নেই চুক্তি বাস্তবায়নের। প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহল চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
ইউপিডিএফ: চুক্তিবিরোধী হিসেবে পরিচিত এই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না বলে তাঁরা মনে করেন। চুক্তি বাস্তবায়ন করার মতো রাজনৈতিক শক্তি ও সদিচ্ছা এই সরকারের নেই। আগের আমলের মতো এবারও সরকার নানা অজুহাতে মেয়াদ শেষ করবে।
ইউপিডিএফের নেতারা দাবি করেন, তাঁদের দল পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে নয়। ২০০০ সালেই ইউপিডিএফ বলেছিল, চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে তাঁরা এর বাস্তবায়ন চান। এ ব্যাপারে সরকার কোনো সহযোগিতা চাইলে তাঁরা তা করতে প্রস্তুত।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলার সমন্বয়ক উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, রাঙামাটি জেলার প্রধান সংগঠক শান্তি দেব চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব মাইকেল চাকমা প্রথম আলোকে এসব কথা বলেছেন। তাঁদের মতে, সরকারই চুক্তির বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া অকার্যকর করে রেখেছে। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর তাঁরা চুক্তি বাস্তবায়নের কাজে হাত দেবেন।
জেএসএস (বিক্ষুব্ধ): জনসংহতি সমিতির এই অংশের সহ-চেয়ারম্যান রূপায়ণ দেওয়ান বলেন, সরকার কার্যত চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী করা; বিদ্রোহ প্রতিরোধ কার্যক্রম (কাউন্টার ইনসার্জেন্সি) জোরদার করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠন করে তার মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালনা করাসহ এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
রূপায়ণ দেওয়ান বলেন, বেশ কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পাহাড়িদের সরানোর একটা উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, যে রকম কার্যক্রম পাকিস্তান আমলেও নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে চুক্তিবিরোধী একটি অংশ সক্রিয় আছে বলেও তাঁরা মনে করেন।
সুশীল সমাজ: চুক্তি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সম্পর্কে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের কথা যত শুনি, সে তুলনায় কাজ কমই দেখি। যে চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়েছে, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন পার্বত্য অঞ্চলের অনেক সমস্যারও অবসান ঘটাবে নিঃসন্দেহে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উচিত এটা অনুধাবন করা।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি এখন পর্যন্ত যে দুটি সভা করেছে, সেখানে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে নীতিনির্ধারণী বা কৌশলগত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের কার্যক্রমের জন্য আইনের বিধিবিধান এখনো করা হয়নি। কোনো উদ্যোগও নেই। শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্সের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরিরও উদ্যোগ নেই। বরং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনসহ এমন কিছু কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, যা চুক্তির সমান্তরাল একটি উদ্যোগ।
জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা বলেন, সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রস্তাব চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে নয়। বরং বিরোধ জিইয়ে রাখার একটা চেষ্টা।
সমঅধিকার আন্দোলন: পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সমান অধিকারের প্রবক্তা এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কামাল প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি স্বাক্ষর একটা ‘স্টান্টবাজি’। এটা করা হয়েছে বিশ্বকে দেখানোর জন্য। কোনো সরকার এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাও ডাকে। আবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও ডাকে। সবার কথাবার্তা শুনে আমাদের ধারণা হয়েছে যে এখানে সবার কাজেরই একটা লক্ষ্য আছে। এর মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন যেকোনো সরকারের জন্য খুব কঠিন।’
প্রতিমন্ত্রী কী বলেন: একদিকে সরকারের অঙ্গীকার চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের। অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে সব পর্যায়ের মানুষের সন্দেহ। এ অবস্থায় সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, যেভাবে বলা হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়নটা সেভাবে নিমেষেই করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সবাইকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সমস্যা সহজে সমাধান করতে পারি, তার সঙ্গে একটা কঠিন বিষয় যদি জুড়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ যদি বলা হয়, এটা না হলে ওটাও হবে না, সে রকম ক্ষেত্রে চুক্তি বাস্তবায়নটা খুবই কঠিন হয়। আমরা যে জিনিসটা করতে পারব, তা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কিছু বাধা আসছে। কঠিন জিনিসটা না করলে সহজ জিনিসটা করা যাবে না। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় বাধা।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। কোনো একটি রাজনৈতিক দলেরও নয়। চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের। পাহাড়ি-বাঙালি সবার। সুতরাং এ সমস্যা সমাধানের জন্য সবাইকে মুক্তমনে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত জেদ, ব্যক্তিগত লাভ-অলাভ, ক্ষতি-স্বার্থ এসব চিন্তা করলে চুক্তি বাস্তবায়নে সমস্যা হবে।
চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে: চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি আরও জটিল ও অস্থিতিশীল হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সন্তু লারমা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে এবং বিদ্যমান অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ তো বেশি দিন এ অবস্থা মানবে না।
ইউপিডিএফের নেতারা বলেন, এই চুক্তি যেহেতু অপূর্ণাঙ্গ, তাই এটা বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটি ঝুলিয়ে রেখে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে রেখে কারও লাভ হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণী-পেশার কিছু সাধারণ মানুষও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আর চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে যে পার্বত্য পরিস্থিতি ক্রমে জটিলতর হবে, তা-ও মনে করেন তাঁরা।


------------

source: the daily prothom-alo (16.09.2010)

No comments:

Post a Comment